পুরোদমে তেল আসবে আজ থেকে

Passenger Voice    |    ০৩:৪১ পিএম, ২০২৪-০৩-০৩


পুরোদমে তেল আসবে আজ থেকে

পরীক্ষামূলকভাবে শুরু হওয়া সাগরের তলদেশে পাইপলাইনে জ্বালানি তেল প্রবাহের কার্যক্রম শুরু হচ্ছে। বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হওয়া তেল সরবরাহ প্রক্রিয়া নানা পরীক্ষা–নিরীক্ষার পর আজ–কালের মধ্যে পুরোদমে শুরু হবে। গতকাল সন্ধ্যায় পাইপলাইনের সবচেয়ে জটিল পরীক্ষা ‘পিগ’ ঠিকভাবে সম্পন্ন হয়েছে। আগামী ৬ মার্চের মধ্যে মহেশখালীর ট্যাংকে থাকা ডিজেল সরবরাহ সম্পন্ন হওয়ার পর ৯ মার্চ ক্রুড অয়েল সরবরাহের প্রক্রিয়া শুরু হবে। মহেশখালী থেকে গত বৃহস্পতিবার চট্টগ্রামের ইস্টার্ন রিফাইনারির পথে পাইপলাইনে পাঠানো পিগ গতকাল সন্ধ্যায় ঠিকভাবে পৌঁছেছে। একইসাথে আড়াই হাজার টন ডিজেলও মহেশখালী থেকে পাইপলাইন ধরে পতেঙ্গায় পৌঁছে। জ্বালানি তেল সরবরাহের নতুন এই সিস্টেম জ্বালানি নিরাপত্তা সুদৃঢ় করার পাশাপাশি বছরে অন্তত ৮শ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে বলছেন সংশ্লিষ্টরা।

বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্ববাজার থেকে আমদানিকৃত জ্বালানি তেল মাদার ভ্যাসেল থেকে দ্রুত ও সাশ্রয়ী খরচে খালাস করার জন্য বঙ্গোপসাগরে ‘ইনস্টলেশন অব সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং উইথ ডাবল পাইপলাইন’ শীর্ষক একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করে। ৫ হাজার কোটিরও বেশি টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়িত এই প্রকল্পে কক্সবাজারের মহেশখালীর অদূরে গভীর সমুদ্রে সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) নির্মাণ করা হয়। ওখান থেকে ৩৬ ইঞ্চি ডায়ার দুটি পাইপলাইন মহেশখালীর স্টোরেজ ট্যাংক পর্যন্ত এবং মহেশখালীর স্টোরেজ ট্যাংক থেকে ইস্টার্ন রিফাইনারি পর্যন্ত ১৮ ইঞ্চি ডায়ার দুটি পাইপলাইন স্থাপন করা হয়। এই প্রকল্পের আওতায় অফশোর এবং অনশোর মিলে ২২০ কিলোমিটার ডাবল পাইপলাইন রয়েছে। 

এর মধ্যে ১৪৬ কিলোমিটার অফশোর পাইপলাইন এবং ৭৪ কিলোমিটার অনশোর পাইপলাইন। প্রকল্পের আওতায় পাইপলাইন ছাড়াও মহেশখালীতে ১ লাখ ২৫ হাজার টন ক্রুড অয়েল এবং প্রায় ৮০ হাজার টন ডিজেল সংরক্ষণের ট্যাংক নির্মাণ করা হয়। বিদেশ থেকে আমদানিকৃত ক্রুড অয়েল এবং ডিজেল ৩৬ ইঞ্চি ডায়ার পৃথক দুটি পাইপলাইনের একটি দিয়ে ডিজেল এবং অপরটি দিয়ে ক্রুড অয়েল ওই দুটি ট্যাংকে সংরক্ষণ করা হবে। পরে প্রয়োজন অনুযায়ী ওখান ইস্টার্ন রিফাইনারি পর্যন্ত টেনে আনা ১৮ ইঞ্চি ডায়ার দুটি পাইপলাইনের একটি দিয়ে ক্রুড অয়েল ইস্টার্ন রিফাইনারির ট্যাংকে এবং অপর পাইপলাইন দিয়ে ডিজেল ইস্টার্ন রিফাইনারির এইচ ট্যাংকের মাধ্যমে পদ্মা অয়েল কোম্পানি, যমুনা অয়েল কোম্পানি এবং মেঘনা পেট্রোলিয়ামের পতেঙ্গার গুপ্তাখাল প্রধান ডিপোতে পাঠানোর ব্যবস্থা রয়েছে।

জার্মানির একটি বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধানে চায়না পেট্রোলিয়াম পাইপলাইন অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং নামের কোম্পানি প্রকল্পটির পাইপলাইনসহ অবকাঠামো নির্মাণ করে। গত বছরের জুলাই মাসে গভীর সাগর থেকে জ্বালানি তেল খালাসের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু ক্রুড অয়েল খালাস শুরু হলে পাইপলাইনসহ প্রকল্পে বেশ কিছু ত্রুটি ধরা পড়ায় তা সম্ভব হয়নি। পরে ক্রটি সারিয়ে ১ ডিসেম্বর সৌদি আরব থেকে আমদানিকৃত ৮২ হাজার টন ক্রুড অয়েলবাহী জাহাজকে বঙ্গোপসাগরে স্থাপিত ভাসমান জেটিতে (এসপিএম বয়া) বার্থিং দেওয়া হয়। জাহাজটি ক্রুড অয়েল খালাস করে চলে যাওয়ার একদিন পরই অপর একটি জাহাজ ৬০ হাজার টন ডিজেল খালাস করে। ক্রুড অয়েল ও ডিজেলগুলো ওখানেই ছিল। পাইপলাইনের কিছু জটিলতায় এগুলো ইস্টার্ন রিফাইনারি কিংবা তিনটি বিপণন কোম্পানির প্রধান ট্যাংকে আনা সম্ভব হচ্ছিল না।

অবশেষে ত্রুটি সারিয়ে গত বৃহস্পতিবার থেকে মহেশখালী থেকে পরীক্ষামূলকভাবে জ্বালানি তেল আনার কার্যক্রম শুরু করা হয়। কিন্তু এই কার্যক্রমও বেশ জটিল।

সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ কর্মকর্তারা জানান, মহেশখালী থেকে ইস্টার্ন রিফাইনারি পর্যন্ত পাইপলাইনে প্রথমে এয়ার ফ্লো (বাতাস) করা হয়েছে। পরে ওয়াটার ফ্লো (পানি) করা হয়েছে। এরপর কিছু তেল পাঠানো হয়েছে। তেল দেওয়ার সাথে সাথে মহেশখালী থেকে ১৮ ইঞ্চি ডায়ার পাইপ লাইনে দুয়েক মিলিমিটার কমের একটি লোহার দণ্ড টাইপের ‘পিগ’ পাঠানো হয়েছে। এই পিগ পাইপলাইনে থাকা ময়লাসহ যাবতীয় অপ্রয়োজনীয় উপাদান ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে দিয়েছে। এটিই এই প্রক্রিয়ার সবচেয়ে জটিল পরীক্ষা। এয়ার ফ্লো এবং ওয়াটার ফ্লোর পর বৃহস্পতিবার সকাল ৮টায় পাইপলাইনে প্রথম স্বল্প পরিমাণে জ্বালানি তেলের প্রবাহ দেওয়া হয়, যা খুব কম প্রেসারে পাঠানো হয়। এই তেল ২৮ ঘণ্টা পর শুক্রবার বেলা ১২টা নাগাদ ইস্টার্ন রিফাইনারিতে পৌঁছে। তেল দেওয়ার কিছু পর কঠিন পরীক্ষার ‘পিগ’ পাঠানো হয়, যা গতকাল সন্ধ্যায় সফলভাবে ইস্টার্ন রিফাইনারিতে রিসিভ করা হয়েছে। এই পিগ পরীক্ষা সফলভাবে শেষ হওয়ার পর জ্বালানি তেলের মূল প্রবাহের কাজ শুরু হবে।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ২৯ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হলেও পুরোদমে তেল সরবরাহ শুরু হবে আজ থেকে। আগামী ৬ মার্চ ইস্টার্ন রিফাইনারির এইচ ট্যাংকে ৪০ হাজার টন জ্বালানি তেল সরবরাহ সম্পন্ন হবে। ডিজেল সরবরাহ শেষ হওয়ার পর আগামী ৯ মার্চ থেকে একই প্রক্রিয়ায় ক্রুড অয়েল সরবরাহ শুরু হবে।

তারা বলেন, প্রচলিত নিয়মে বিদেশ থেকে আমদানিকৃত জ্বালানি তেল লাইটারেজ জাহাজের মাধ্যমে পরিবহন করা হতো। একটি জাহাজ থেকে তেল খালাসে আগে ১৫ দিন সময় লাগত। এখন তা ৩৬ থেকে ৪৮ ঘণ্টায় নেমে আসবে। নতুন এই প্রক্রিয়ায় জ্বালানি তেল আমদানিতে লাইটারিং সিস্টেম উঠে যাবে। এতে সময় ও অর্থ দুটোই সাশ্রয় হবে। প্রাথমিকভাবে বছরে অন্তত ৮শ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে।

ইস্টার্ন রিফাইনারির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ লোকমান বলেন, পাইপলাইনে জ্বালানি তেল সরবরাহের নতুন যুুগে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ। সবকিছু ঠিক রয়েছে। মহেশখালী থেকে পাঠানো ডিজেল আমরা রিসিভ করতে শুরু করেছি। এটি দেশের জ্বালানি নিরাপত্তাসহ সার্বিক ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে।


প্যা/ভ/ম